গবেষণায় স্বল্প খরচে একই ধানগাছ থেকে দুইবার ধান উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) সাবেক দুই শিক্ষার্থী সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম এবং মোঃ তানজিমুল ইসলাম।

গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অফ বাংলাদেশি বায়োটেকনোলজিস্ট অরগানাইজেশান (GNOBB) এর অর্থায়নে উক্ত গবেষণা কার্যক্রমে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন খুবির এগ্রো-টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম।

ধান কর্তনের পর (ধানের গোড়া) থেকে সামান্য যত্নে সহজ উপায়ে আবারো ধান উৎপাদনের এই প্রযুক্তিকে কৃষি বিজ্ঞানে বলা হয় রেটুন ক্রপ। মুড়ির ধান (রেটুনিং) চাষের কার্যকারিতা অনুসন্ধানের জন্য ২০২১ সালের নভেম্বর হতে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত খুলনার বটিয়াঘাটায় মাঠ পরীক্ষা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই সাবেক শিক্ষার্থী।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমন রোপণের আগে, বোরো কাটার পর ৪৫ থেকে ৭০ দিন জমি পতিত থাকে। মুড়ি ধান চাষের মাধ্যেম (রেটুনিং) অর্থাৎ কেটে নেওয়া ধান গাছের গোড়া পরিচর্যার মাধ্যমে এসব জমির সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব। উচ্চ লবণাক্ত মাটি (৮.১ dS/m) অবস্থায় মুড়ি ফসল সম্ভব না হলেও ৩.৯ dS/m মাত্রার লবণাক্ত মাটিতে মুড়ি চাষ সম্ভব।

এ পদ্ধতিতে গাছকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় কেটে (গোড়া থেকে ৩০ সেমি উপরে) রেখে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলে, সামান্য পরিমাণে সেচ এবং সার প্রয়োগ এবং অল্প মাত্রায় কীটনাশক স্প্রে করে মাত্র ৩৫-৬৫ দিনের মধ্যে (ধানের জাতের উপর নির্ভর করে) একই জমি থেকে আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল ফসলের ৩৫% পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। ফলে বোরো ধান কাটার পর বর্ষা বা বন্যা আসার আগেই দ্বিতীয় পর্যায়ের ফলন (রেটুন ক্রপ) ঘরে তুলতে পারবে কৃষক।

এ গবেষণার ব্যাপারে সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- অকাল বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির একটি উপায় হিসেবে মুড়ি ধান চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। কারণ খাদ্য নিরাপত্তায় মুড়ি ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মুড়ি ধান চাষ করে মূল ফসলের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্তও ফলন পাওয়া সম্ভব।

চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে গবেষকগণ জানান, বোরো মৌসুমের আগাম জাত মুড়ি ধান উৎপাদনের জন্য উপযোগী। এ পদ্ধতিতে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য এ জাতগুলোর পাকা ধান কিছুটা সবুজ থাকা অবস্থায় কাটতে হবে; সাধারণত বোরো মৌসুমে মধ্যম উঁচু জমিতে মুড়ি ধান চাষ করা যায়, মুড়ি ধান চাষের জন্য মূল ফসল কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ২০-৪০ সেন্টিমিটার নাড়া বা ২-৩টি নোড বা পর্ব রেখে ফসল কাটতে হবে; মূল ফসল কাটার ৫-৭ দিন পর বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া ও ৫ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করলে বিঘাপ্রতি ৫-৬ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়, বোরো-পতিত-রোপা আমন এ শস্য বিন্যাস মুড়ি ধান চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মুড়ি ধান চাষে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি রাখতে হবে যেন নাড়া থেকে কুশি জন্মাতে পারে এবং নতুন কুশি মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে; মুড়ি ধান চাষের জন্য এমন জাতের ধান নির্বাচন করতে হবে যার কুশি উৎপাদন ক্ষমতা বেশি এবং বাতাসে সহজে ঢলে পড়ে না; মুড়ি ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

এ চাষ সম্পর্কে আশার কথা জানিয়েছেন গবেষকদল। তারা বলেন, এতে মূল ফসলের অতিরিক্ত প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফলন হতে পারে। পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে বীজ ধান বীজতলা ও জমি তৈরি এবং রোপণ খরচ লাগে না বিধায় এটি ব্যয় সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। তাছাড়া মূল ফসলের চেয়ে মুড়ি ধান পাকতে ৬৫ ভাগ কম সময় লাগে এবং মুড়ি ধানের জন্য জমি তৈরি ও চারা রোপণ করতে হয় না এবং সেচ, সার ও শ্রমিক খরচ ৫০-৬০ ভাগ কম লাগে। একবার চাষ করে একই জমি থেকে দুইবার ফলন পাওয়ায় শস্যের নিবিড়তাও বাড়ে।

কৃষকদের উদ্দেশ্য তারা বলেন, মুড়ি ধান পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিধায় পরবর্তী মৌসুমে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। তাছাড়া মুড়ি ধান চাষের সফলতা মূল ফসলের আন্তঃপরিচর্যার ওপর নির্ভর করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুড়ি ধান চাষে পরবর্তী মৌসুমের জমি তৈরি ও ফসল চাষে দেরি হতে পারে। আগাম জাত নির্বাচন মুড়ি ধান ফসলের জন্য ভালো। পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে ধান চাষের সময় জমিতে ১-১.৫ ইঞ্চি পানি রাখলে ফলন ভালো হয়।